ঢাকা শুক্রবার, ২৮ নভেম্বর ২০২৫

নকল খবরের বিস্তার : সাধারণ মানুষ কতটা সচেতন?

নিউজ ডেস্ক

প্রকাশিত: ২৪ নভেম্বর, ২০২৫, ১০:৩৭ রাত

সুমাইয়া ইসরাত ইভা

আজকের পৃথিবী তথ্যপ্রযুক্তির বিস্ময়কর অগ্রগতির কারণে এক ভিন্ন উচ্চতায় পৌঁছে গেছে। ডিজিটাল যুগে তথ্য এখন হাতের মুঠোয় একটি স্মার্টফোন আর ইন্টারনেট থাকলেই পৃথিবীর যেকোনো প্রান্তের খবর মুহূর্তেই জানা সম্ভব। তথ্যপ্রাপ্তির এই সহজলভ্যতা মানুষের জ্ঞান-বিস্তারে যেমন ভূমিকা রাখছে, তেমনি এর আড়ালেই লুকিয়ে আছে এক ভয়াবহ সংকট নকল খবর বা ভুয়া তথ্যের বিস্তার।
 
সামাজিক মাধ্যমের সীমাহীন স্বাধীনতা, অ্যালগরিদমের মনস্তাত্ত্বিক খেলা এবং মানুষের আবেগপ্রবণ আচরণ মিলিয়ে তৈরি হয়েছে এমন এক পরিবেশ, যেখানে সত্যের চেয়ে মিথ্যা তথ্য দ্রুত বেশি ছড়ায়। আমরা এখন এক ধরনের তথ্য-জঞ্জালের মধ্যে বাস করছি। ফলে প্রশ্ন ওঠে এই বিপুল তথ্যস্রোতে ভাসতে ভাসতে সাধারণ মানুষ কতটা সচেতন? সত্য-মিথ্যার পার্থক্য করার সক্ষমতা কতটা তাদের রয়েছে? বর্তমান সময়ে এটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন।
 
ফেইক নিউজ নতুন কোনো ঘটনা নয়। তবে এর গতি ও ব্যাপ্তি এখন আগের যেকোনো সময়ের তুলনায় অনেক বেশি। আগে ভুল তথ্য ছড়াতে সময় লাগত, প্রয়োজন ছিল বিভিন্ন মাধ্যমের। এখন তা কয়েক মিনিটেই লাখো মানুষের কাছে পৌঁছে যায়। বিশেষ করে তরুণ প্রজন্ম সামাজিক মাধ্যমে এত সক্রিয় যে একটি ভুয়া পোস্ট, নকল ছবি বা এডিট করা ভিডিও মুহূর্তেই ভাইরাল হয়ে যায়। দুঃখজনকভাবে, আমাদের উল্লেখযোগ্য অংশ এসব তথ্যের উৎস যাচাই না করেই শেয়ার করে। অ্যালগরিদম জনপ্রিয় পোস্টকে আরও উপরে তুলে ধরে এবং মানুষ সত্য যাচাইয়ের আগেই মন্তব্য ও শেয়ার করে বিভ্রান্তি ছড়িয়ে দেয়। এতে বোঝা যায়, সাধারণ মানুষের বড় অংশ এখনো এই ডিজিটাল সাইবার যুদ্ধের কৌশল সম্পর্কে অজ্ঞ; তাদের অজান্তেই তারা নকল তথ্য ছড়ানোর বাহক হয়ে ওঠে।
 
নকল খবর ছড়ায় ইচ্ছাকৃত ও অনিচ্ছাকৃত দুভাবেই। তবে বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই এগুলো তৈরি হয় পরিকল্পিতভাবে কাউকে বিভ্রান্ত করা, ভাবমূর্তি নষ্ট করা, সামাজিক অস্থিরতা সৃষ্টি করা বা দর্শক-টানার লোভ থেকে। বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে রাজনৈতিক খবর, ধর্মীয় অনুভূতি, সেলিব্রেটি গুজব, স্বাস্থ্য-চিকিৎসা বিষয়ক ভ্রান্ত তথ্য সবচেয়ে বেশি ছড়ায়। বিভিন্ন ভুয়া পেজ, অবিশ্বস্ত ওয়েবসাইট ও ইউটিউব চ্যানেল এসব গুজব ছড়ায় এবং উৎস যাচাই না করে সাধারণ মানুষ তা শেয়ার করে পরিস্থিতি আরও জটিল করে তোলে। সাম্প্রতিক জাতীয় ঘটনাবলী থেকে বৈশ্বিক রাজনীতির চিত্র পর্যন্ত সবকিছুই ইঙ্গিত দেয় নকল তথ্য এখন সমাজের স্থিতিশীলতা ও জননিরাপত্তার জন্য সরাসরি হুমকি। এই অদৃশ্য ডিজিটাল মহামারী তৈরি করছে আতঙ্ক, সহিংসতা, বিভাজন ও গণবিশ্বাসের সংকট।
 
নকল তথ্য তৈরির শক্তিশালী হাতিয়ার হয়ে উঠেছে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (AI)। এটি যেমন মানুষের কাজ সহজ করছে, তেমনি ভুয়া তথ্য ছড়ানোর ক্ষমতাও বহুগুণ বাড়িয়ে দিয়েছে। AI-এর মাধ্যমে মানুষের মুখ, কণ্ঠস্বর ও অভিব্যক্তি এমন নিখুঁতভাবে নকল করা যায় যে সত্য-মিথ্যার সীমারেখা প্রায় মুছে যায়। এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে ডিজিটাল স্বাক্ষরতার অভাব। উত্তেজনাপূর্ণ তথ্যের প্রতি মানুষের স্বাভাবিক আকর্ষণ, আবেগের বশবর্তী হওয়া, উৎস যাচাই করতে অনীহা—সব মিলিয়ে নকল খবর আরও দ্রুত ছড়ায়। বিশেষ করে গ্রামের মানুষ, প্রবীণ ও কম শিক্ষিত জনগোষ্ঠী এসব প্রতারণার শিকার বেশি হলেও শহুরে তরুণরাও নিরাপদ নয়। গবেষণা বলছে, বেশিরভাগ মানুষ খবর পড়ার আগে উৎস দেখে না, লিংক খুলে না শুধু হেডলাইন দেখে সিদ্ধান্ত নেয়। সচেতনতার এই ঘাটতিই পরিস্থিতিকে সবচেয়ে বেশি ঝুঁকিপূর্ণ করে তুলেছে।
 
একটি ভুল তথ্যের পরিণতি হতে পারে ভয়াবহ। অনেকে এটি তুচ্ছ ভাবলেও এর অভিঘাত ব্যক্তিগত, সামাজিক এবং মনস্তাত্ত্বিক ক্ষেত্রে দীর্ঘস্থায়ী। মানহানি, সাইবার বুলিং, ব্ল্যাকমেইল এসব ঘটনার পেছনে নকল তথ্য বড় ভূমিকা রাখে। অনেক সময় একটি ভুয়া তথ্য মানুষকে বিপদজনক সিদ্ধান্ত নেওয়ার দিকেও ঠেলে দেয়।
 
তবে আশার কথা হলো, সাম্প্রতিক বছরে কিছু ইতিবাচক পরিবর্তন দেখা যাচ্ছে। নতুন প্রজন্মের মধ্যে ফ্যাক্ট-চেকিংয়ের প্রবণতা বেড়েছে। স্কুল-কলেজে ডিজিটাল স্বাক্ষরতায় জোর দেওয়া হচ্ছে। শিক্ষা কার্যক্রমে ইনফরমেশন লিটারেসি, মিডিয়া লিটারেসি ও ফ্যাক্ট-চেকিং দক্ষতা অন্তর্ভুক্ত করার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। মিডিয়াও সচেতনতা তৈরিতে কাজ করছে। তবু বাস্তবতা হলো—এই সচেতনতা এখনো সীমিত পরিসরে; পুরো সমাজে তা ছড়িয়ে পড়েনি।
 
সুতরাং নকল খবর প্রতিরোধে সবচেয়ে জরুরি হলো মানুষের সচেতন হওয়া। ভুয়া তথ্য শুধু প্রযুক্তিগত সমস্যা নয় এটি মানুষের মনস্তত্ত্ব, বিচারক্ষমতা ও সামাজিক আচরণের সঙ্গে সম্পর্কিত। প্রযুক্তি যতই উন্নত হোক না কেন, মানুষের বিবেক, যুক্তি ও সত্য যাচাইয়ের প্রবণতা না বাড়লে সমস্যার সমাধান হবে না। ডিজিটাল যুগে “তথ্যই শক্তি”, তবে ভুল তথ্য হতে পারে মারাত্মক হুমকি। তাই সচেতনতার কোনো বিকল্প নেই।
 
লেখক:
সুমাইয়া ইসরাত ইভা
শিক্ষার্থী,
শিক্ষা ও গবেষণা ইনস্টিটিউট
জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়।

Link copied!