ঢাকা শুক্রবার, ১৯ ডিসেম্বর ২০২৫

ডিজিটাল মুদ্রা বনাম প্রচলিত ব্যাংকিং : পৃথিবী কি প্রস্তুত?

সুমাইয়া ইসরাত ইভা

প্রকাশিত: ০১ ডিসেম্বর, ২০২৫, ১২:১৯ দুপুর

সুমাইয়া ইসরাত ইভা

২১শ শতকের অর্থনীতি শুধু প্রযুক্তিনির্ভর নয় প্রযুক্তিকেন্দ্রিক এই বাস্তবতা আমাদের আর্থিক ধারণাকেও বদলে দিচ্ছে। বহু শতাব্দী ধরে প্রচলিত ব্যাংকিং ব্যবস্থা মানুষকে নিরাপদ আর্থিক আশ্রয় দিয়ে এসেছে।
 
কিন্তু গত দশ বছরে ডিজিটাল প্রযুক্তির বিস্ময়কর অগ্রগতি এই প্রতিষ্ঠিত ব্যবস্থাকে নতুনভাবে ভাবতে বাধ্য করেছে। ক্রিপ্টোকারেন্সি, স্টেবলকয়েন এবং সেন্ট্রাল ব্যাংক ডিজিটাল কারেন্সি (CBDC) । মুদ্রা সংরক্ষণ, ঋণ প্রদান, বিনিয়োগ ব্যবস্থাপনা, আন্তর্জাতিক লেনদেন এসবের ওপরই দাঁড়িয়ে গড়ে উঠেছে বিশ্ব অর্থনীতিএগুলো এখন আর ভবিষ্যতের কল্পনা নয়; বরং বর্তমানের বাস্তবতা।
 
ডিজিটাল মুদ্রার বিকাশ মানুষের লেনদেনের পদ্ধতি পাল্টে দিচ্ছে। একই সঙ্গে পরিবর্তন আনছে বৈশ্বিক বাণিজ্য, আর্থিক নীতি এবং রাষ্ট্রীয় নিয়ন্ত্রণব্যবস্থায়। প্রশ্ন উঠছে ডিজিটাল মুদ্রা কি প্রচলিত ব্যাংকের বিকল্প হয়ে উঠবে, নাকি এটি কেবল নতুন এক প্রতিযোগিতার যুগ? আর সবচেয়ে বড় প্রশ্ন পৃথিবী কি এমন রূপান্তরের জন্য প্রস্তুত?
 
ডিজিটাল মুদ্রার আলোচনার কেন্দ্রে রয়েছে দ্রুত লেনদেন, স্বচ্ছতা, আন্তর্জাতিক পেমেন্টের সহজতা এবং মধ্যস্থতাহীন আর্থিক স্বাধীনতার প্রতিশ্রুতি। বিকেন্দ্রীভূত ক্রিপ্টোকারেন্সি মানুষকে এমন এক ধারণা দিয়েছে যেখানে ব্যাংক বা রাষ্ট্রের নিয়ন্ত্রণ ছাড়াই আর্থিক লেনদেন সম্ভব। ফলে খুব কম খরচে, দ্রুত ও নিরাপদ লেনদেন এখন বাস্তবতা।
 
অন্যদিকে স্টেবলকয়েন ও CBDC ডিজিটাল মুদ্রাকে আরও বিশ্বাসযোগ্য করে তুলেছে। চীন, জাপান, ইউরোপসহ বিশ্বের উন্নত দেশগুলো নিজস্ব সরকারি ডিজিটাল মুদ্রা চালুর চেষ্টা চালাচ্ছে। এর মানে বিশ্ব আর কাগুজে টাকা বা চেকবইয়ের ওপর এককভাবে নির্ভরশীল থাকতে চাইছে না।
 
তবে প্রচলিত ব্যাংকিং এখনো তার শক্ত অবস্থান ধরে রেখেছে। শতবর্ষের অভিজ্ঞতা, মানুষের দীর্ঘমেয়াদি বিশ্বাস, আইন–নীতিনির্ভর নিয়ন্ত্রণব্যবস্থা, আমানতের নিরাপত্তা এসবই ব্যাংককে এখনো অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতার কেন্দ্রবিন্দুতে রাখে। তবুও সীমাবদ্ধতাও রয়েছে ধীরগতি, জটিল প্রক্রিয়া, উচ্চ চার্জ, প্রযুক্তিতে পিছিয়ে থাকা যার কারণে অনেকেই ডিজিটাল বিকল্পের দিকে ঝুঁকছে। বিশেষ করে তরুণ প্রজন্ম, ফ্রিল্যান্সার ও আন্তর্জাতিক পেমেন্ট ব্যবহারকারীরা দ্রুতই ডিজিটাল সমাধান গ্রহণ করছে।
 
সবচেয়ে বড় বিতর্কের জায়গা হলো নিরাপত্তা। ডিজিটাল মুদ্রা যতই সম্ভাবনাময় হোক, ততই ঝুঁকিপূর্ণও। সাইবার আক্রমণ, এক্সচেঞ্জ হ্যাকিং, প্রতারণা, মূল্য অস্থিরতা, আইনগত অস্পষ্টতা এসব কারণে এর ওপর পূর্ণ বিশ্বাস স্থাপন কঠিন। ক্রিপ্টোকারেন্সির দাম মুহূর্তে বেড়ে যায়, আবার মুহূর্তেই অর্ধেকে নেমে আসে। ওয়ালেট হারালে বা হ্যাক হলে অর্থ ফেরত পাওয়ারও কোনো নিশ্চয়তা নেই। আর সরকারি নিয়ন্ত্রণের অনুপস্থিতি অর্থনীতিকে ঝুঁকিতে ফেলে।
 
অন্যদিকে প্রচলিত ব্যাংকিংয়ে ঝুঁকি থাকলেও রয়েছে শক্ত আইন, সরকারি নিরাপত্তাব্যবস্থা ও সংকট মোকাবিলার ব্যবস্থা যা এটিকে তুলনামূলকভাবে স্থিতিশীল করে তোলে।
 
তবে বাস্তবতা হলো প্রচলিত ব্যাংক ও ডিজিটাল মুদ্রার মধ্যে কোনো সরাসরি প্রতিদ্বন্দ্বিতা নয়, বরং সহাবস্থান গড়ে উঠছে। বিশ্বের অনেক বড় ব্যাংক ইতোমধ্যে ব্লকচেইন প্রযুক্তি ব্যবহার করছে দ্রুত লেনদেনের জন্য। আবার অনেক দেশ ডিজিটাল মুদ্রাকে ব্যাংক ব্যবস্থার সঙ্গে একীভূত করার পথে এগোচ্ছে। তাই বলা যায়, ডিজিটাল মুদ্রা ব্যাংককে বিলুপ্ত করবে না; বরং ব্যাংককে আরও প্রযুক্তিনির্ভর হতে বাধ্য করবে।
 
তবে বিশ্বের প্রস্তুতি সমান নয়। উন্নত দেশগুলো প্রযুক্তিগতভাবে সক্ষম হওয়ায় তারা ডিজিটাল মুদ্রা গ্রহণে প্রায় প্রস্তুত। তাদের রয়েছে শক্তিশালী সাইবার নিরাপত্তা, প্রযুক্তিগত অবকাঠামো ও উচ্চ ডিজিটাল সাক্ষরতা।
 
অন্যদিকে উন্নয়নশীল দেশগুলো বাংলাদেশসহ ইন্টারনেট প্রবেশাধিকার, প্রযুক্তিগত অদক্ষতা, সাইবার ঝুঁকি ও নীতিনির্ধারণী সীমাবদ্ধতার কারণে এখনো অনেক পিছিয়ে। ফলে এখানে ডিজিটাল মুদ্রা গ্রহণের পথ দীর্ঘ ও চ্যালেঞ্জপূর্ণ।
 
তবুও পরিবর্তনের ধারা থামানো সম্ভব নয়। অনলাইন পেমেন্ট, মোবাইল ব্যাংকিং, ই-কমার্স সব ক্ষেত্রেই মানুষের অভ্যাস বদলে যাচ্ছে। সরকারও ভবিষ্যৎ অর্থনীতির জন্য নতুন নীতি প্রণয়নে কাজ করছে।
 
সন্দেহ নেই ডিজিটাল মুদ্রা বিশ্ব অর্থনীতিকে নতুন রূপ দেবে। এটি হবে দ্রুত, স্বচ্ছ, প্রযুক্তিভিত্তিক এবং সীমান্তহীন লেনদেনের ভবিষ্যৎ। তবে প্রচলিত ব্যাংকিংও সমানভাবে গুরুত্বপূর্ণ, কারণ এটি অর্থনীতির নিরাপত্তা, নিয়ন্ত্রণ এবং জনআস্থার ভরসাস্থল।
 
সুতরাং, পৃথিবী এখনো পুরোপুরি প্রস্তুত না হলেও প্রস্তুতির পথে দ্রুত এগিয়ে যাচ্ছে। ভবিষ্যৎ অর্থনীতি গড়ে উঠবে কাগুজে টাকা ও ডিজিটাল মুদ্রার সমন্বয়ে যেখানে ডিজিটাল মুদ্রা ব্যাংকিংকে প্রতিস্থাপন করবে না; বরং একসঙ্গে মিলেই এগিয়ে নেবে আগামী দিনের বিশ্ব অর্থনীতি।
 
সুমাইয়া ইসরাত ইভা
শিক্ষা ও গবেষণা ইনস্টিটিউট।
 
 

Link copied!