ঢাকা শুক্রবার, ১৯ ডিসেম্বর ২০২৫

সরলতায় সুখের আইডিয়া মিনিমালিজম

ফারহান আহমদ তাওসীফ

প্রকাশিত: ০১ ডিসেম্বর, ২০২৫, ১১:৫৯ দুপুর

দুই দশক পর সম্প্রতি বাংলাদেশের জনপ্রিয় মোবাইল অপারেটর কোম্পানি বাংলালিংক তাদের লোগো এবং ট্যাগলাইন পরিবর্তন করেছে। নতুন লোগোটি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ব্যাপক আলোচনার সৃষ্টি করেছে। বিশেষ করে ডিজাইনার এবং সাধারণ ব্যবহারকারীরা এটিকে 'মিনিমাল' ধাঁচের লোগো হিসেবে প্রশংসা করেছেন। মিনিমাল লোগো মানে সহজ, সাধারণ এবং অতিরিক্ত জটিলতা বা অলঙ্কারবিহীন। তবে এই সরলতার ভেতরে লুকানো থাকে গভীর ভাবনা এবং এক ধরনের ধারণা বা দর্শন। বাংলালিংকের নতুন লোগো আমাদেরকে আবারো মিনিমালিজম বা সরলতাবাদের ধারণার দিকে নিয়ে যায়, যা শুধুমাত্র লোগো বা ডিজাইনের ক্ষেত্রে নয়, বরং জীবনের দৃষ্টিকোণ থেকেও গুরুত্বপূর্ণ।
 
মিনিমালিজম শব্দটির মূল অর্থ হলো সাধারণ, সরল বা অল্পমাত্রিক। এটি এমন একটি ধারণা যা অতিরিক্ত জটিলতা, অলঙ্কার, চাকচিক্য এবং অপ্রয়োজনীয় জিনিসের বিরোধী। মিনিমালিজম শুধু শৈল্পিক বিষয় বা ডিজাইনের ক্ষেত্রে নয়, বরং এটি জীবনযাপনের প্রতিটি ক্ষেত্রে প্রয়োগ করা যায়। এটি আমাদের শেখায় কিভাবে অপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্র, ব্যবহৃত নয় এমন বস্তু, অযথা ব্যস্ততা এবং অতিরিক্ত অলঙ্কার থেকে মুক্ত হয়ে জীবনের মূল উদ্দেশ্য ও গুরুত্বপূর্ণ দিকগুলোতে মনোযোগ দিতে হয়।
 
আমাদের চারপাশের সামাজিক জীবন আমাদের মনোযোগ আকর্ষণের জন্য প্রতিনিয়ত বিজ্ঞাপন, মার্কেটিং এবং প্রচারের মাধ্যমে চাপ সৃষ্টি করে। গবেষণা বলছে, প্রতিদিন আমরা প্রায় পাঁচ সহস্রাধিক বিজ্ঞাপনের মুখোমুখি হই। প্রতিটি বিজ্ঞাপন আমাদেরকে কিছু না কিছু কেনার জন্য বা কোনো ট্রেন্ড অনুসরণের জন্য প্ররোচিত করে। চাই সেটা নতুন ফোন, নতুন পোশাক বা নতুন জীবনধারা বা লাইফস্টাইল হোক। সেইসব আকর্ষণীয় বিজ্ঞাপন আমাদের চিন্তার উপর প্রভাব বিস্তার করে আমাদের নিজেদের উপর থেকে নিজেদের মনযোগ সরিয়ে দেয়। এই বিপুল চাকচিক্য ও আকর্ষণের স্রোতের বিপরীতে মিনিমালিজম আমাদের শেখায় নিজের মনকে নিয়ন্ত্রণ করা, নিজের সময়, অর্থ এবং শক্তি সচেতনভাবে ব্যবহার করা এবং জীবনে স্বাভাবিকতা আনয়ন করা। অর্থাৎ শুধুমাত্র প্রয়োজনীয় ও গুরুত্বপূর্ণ জিনিসের প্রতি আমাদের দৃষ্টি কেন্দ্রীভূত করা, যেন আমরা জীবনের দূরতম লক্ষ্য অর্জনে সক্ষম হই।
 
আধুনিক সমাজে আমরা প্রায়ই ভেবে চলি যে সুখ আসে নতুন কিছু কেনা বা সংগ্রহের মাধ্যমে। কিন্তু বাস্তবতা হলো অতিরিক্ত জিনিসপত্র আমাদের ওপর বোঝা হয়ে দাঁড়ায়। অপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্র সাময়িক আনন্দ দিতে পারে, কিন্তু দীর্ঘমেয়াদে মানসিক চাপ, অগোছালো জীবন এবং অচেতন ব্যয় সৃষ্টি করে। একাধিক গবেষণা দেখিয়েছে, কম জিনিসে জীবন যাপন করা মানসিক শান্তি, সন্তুষ্টি এবং মনোযোগ বৃদ্ধিতে সাহায্য করে।
 
মিনিমালিজম আমাদের শেখায় জীবনকে গুরুত্ব বা প্রায়োরিটির ভিত্তিতে সাজানো। আমাদের দৈনন্দিন জীবনে কোন কাজ, কোন সম্পর্ক বা কোন অভ্যাস সত্যিকারের মূল্যবান, তা চিনতে সাহায্য করে। এটি শুধু অর্থনৈতিক বা বস্তুগত জিনিসের জন্য নয়, মানসিক দিক থেকেও গুরুত্বপূর্ণ। আমরা অনেক সময় ছোটখাটো কোনো বিষয়, অতীতের ক্ষত, ভয় বা অহেতুক চিন্তায় ব্যস্ত থাকি। মিনিমালিজম এই অপ্রয়োজনীয় মানসিক বোঝা সরিয়ে দেয় এবং আমাদের জীবনের মূল উদ্দেশ্য ও মূল্যবোধের প্রতি দৃষ্টি দেওয়ার প্রতি উদ্বুদ্ধ করে।
 
একটি উদাহরণ দিলে সহজে বোঝা যায়। ধরুন, একজন ব্যক্তির আলমারি ভর্তি অজস্র জামা-কাপড়। কিন্তু তার মধ্যে মাত্র কয়েকটি পোশাকই সে নিয়মিত ব্যবহার করে। বাকি সব পোশাক শুধু স্থান দখল করছে, যেগুলো তার নিত্যপ্রয়োজনীয় নয়। আর এতো এতো পোশাক অগোছালো অবস্থায় তার মানসিক চাপ সৃষ্টি করছে। যদি সে শুধুমাত্র ব্যবহারযোগ্য এবং প্রিয় পোশাক রেখে বাকিগুলো সরিয়ে দেয়, তখন সে দেখবে জীবন অনেক সহজ, শান্ত এবং সুখের। ঠিক একইভাবে, জীবনের অপ্রয়োজনীয় কাজ, সম্পর্ক বা অভ্যাসগুলোকে দূরে সরিয়ে দিলে সময়, শক্তি এবং আনন্দের জন্য নতুন জায়গা তৈরি হয়।
 
মিনিমালিজম জাপানি নাগরিকদের নিত্যসঙ্গী। জাপানের মানুষ খুব সাধারণ জীবনযাপনে অভ্যস্ত, যদিও তাদের ক্ষমতা আছে অত্যন্ত জাঁকজমকপূর্ণ ও আড়ম্বরপূর্ণ জীবনযাপন করার। তাদের ঘর সুসজ্জিত থাকে, তবে অতিরিক্ত আসবাবপত্রে ভরপুর হয় না। অপ্রয়োজনীয় সাজগোজ, পোশাক-আশাক তারা পরিহার করে। খাবারের ক্ষেত্রেও তারা সংযমী। এর ফলে তারা মানসিক শান্তি, সৃজনশীলতা এবং পরিপূর্ণতার মধ্যে থাকে। জাপানি সংস্কৃতিতে ‘ওয়াবি-সাবি’ ধারণা অনুসারে, সরলতা এবং নীরবতার মধ্যে প্রকৃত সৌন্দর্য নিহিত।
 
মিনিমালিজমকে একটি বিপ্লবী ধারণা বলা যায়। এটি প্রচলিত অতিরিক্ত ভোগ, অহংকার এবং অযথা ব্যস্ততার সংস্কৃতিকে প্রত্যাখ্যান করে। এটি শেখায় কিভাবে কম দিয়ে বেশি মূল্য তৈরি করা যায়, কিভাবে সরলতার মাধ্যমে জীবনকে অর্থবহ এবং সুন্দর করা যায়। আমাদের জীবনেও যদি আমরা অপ্রয়োজনীয় জিনিস এবং বোঝা কমাই, আমাদের দৃষ্টি এবং শক্তি সত্যিকারের গুরুত্বপূর্ণ জিনিসের প্রতি কেন্দ্রীভূত করি, তাহলে আমরা আরও শান্ত, আরও সৃজনশীল এবং আরও পরিপূর্ণ জীবনযাপন করতে পারব। আমরা নিজের জীবন নিয়ন্ত্রণে আনতে পারবো, মানসিক চাপ কমাতে পারবো এবং সত্যিকারের উদ্দেশ্যপূর্ণ জীবন অর্জন করতে পারব। সরলতার মধ্যে লুকানো গভীর অর্থ, নিজের মূল্যবোধ ও লক্ষ্য অনুসরণের অনুপ্রেরণা এগুলোই মিনিমালিজমের প্রকৃত সৌন্দর্য। মিনিমালিজম শুধু একটি ডিজাইন বা লোগোর ধরন নয়, বরং জীবনের একটি দর্শন, যা আমাদের শেখায় কম দিয়ে বেশি সুখ ও অর্থবহ জীবন কিভাবে পাওয়া যায়।
 
 
ফারহান আহমদ তাওসীফ 
 
শিক্ষার্থী, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। 
 
সদস্য, বাংলাদেশ তরুণ কলাম লেখক ফোরাম, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শাখা। 
 
ইমেইল: f.tawsif199@gmail.com
 

Link copied!